নিজস্ব প্রতিবেদক
নির্বাচনী এলাকায় গত ১৫ বছরে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেও ধরাশায়ী হয়েছেন গাজীপুর-৫ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। রবিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী ডাকসুর সাবেক ভিপি আকতারউজ্জামানের কাছে ১২ হাজার ২৪৪ ভোটে হেরে যান তিনি। নেতাকর্মী এবং নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে নেতা-কর্মীদের অপকর্ম, আত্মীয়করণ, অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো এবং এপিএস সেলিম কান্ডেই ডুবেছে চুমকির নৌকা।
নেতা-কর্মীরা বলেন, কালীগঞ্জ উপজেলা, গাজীপুর মহানগরীর পূবাইল থানার ৩টি ওয়ার্ড ও সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত গাজীপুর-৫ আসন। ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে চুমকির এপিএস নিয়োগ পান মাজেদুল ইসমলাম সেলিম। রাতারাতি তিনি হয়ে উঠেন চুমকির পর দ্বিতীয় ক্ষমতাধর। চুমকির পরাজয়ের নানা কারণের একটি সেলিম ও তার বাহিনীর বিতর্কিত কর্মকান্ড দাবি অনেকের।
নির্বাচনে চুমকির পরাজয়ে আত্মীয়দের অপকর্মকে দায়ী করেছেন নেতাকর্মীরা। তাদের ভাষ্য, এমপি হওয়ার পর চুমকির অষ্টম শ্রেণী পাশ বেকার চাচাতো ভাই মো. আলমগীর হোসেনের ক্ষমতাও বেড়ে যায় বহুগুণ। রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও মোক্তারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় তাকে। প্রভাববিস্তার করে গত ইউনয়ন পরিষদ নির্বাচনে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আলমগীর। নির্বাচিত হওয়ার পর আরো বেপারোয়া হয়ে উঠেন তিনি। নিজের আপন ৭ ভাইকে নিয়ে নানা কর্মকান্ডে কয়েক বছরের ব্যবধানে নি:স্ব থেকে তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। গত ৩-৪ মাস আগে প্রকাশ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করে নতুন করে আলোচনায় আসেন তিনি। চুমকির আরেক ফুফাত ভাই আলমগীর হোসেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি। এলাকায় তিনি পরিচিতি ‘আতংক’ হিসেবে।
কালীগঞ্জের রাজনীতিতে অপরিচিত মুখ এসএম রবিন হোসেন ছিলেন হার্ডওয়ার ব্যবসায়ী। এমপির ঘনিষ্ট হওয়ায় সুবাদে দুইবছর আগে অনুষ্ঠিত কালীগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে তাকে পৌর মেয়র নির্বাচিত করা হয় রবিনকে। পরে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় তাকে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন কাজ করতে না পারায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। মতামত আমলে না নেওয়া এবং কাজেকর্মে দূরে রাখায় দুই-একজন ছাড়া পৌরসভার সব কাউন্সিলর তার বিপক্ষে। নাগরী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়্যারম্যান অলিউর রহমান অলি ছিলেন আমেরিকা প্রবাসী। তিন বছর আগে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আমেরিকা থেকে এসে আওয়ামী লীগের সমর্থনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন অলি। এর পর তাকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয়। নির্বাচিত হয়ে অলি জড়িয়ে পড়েন রাজউকের পূর্বচল উপশর প্রকল্পের প্লট জালিয়াতিতে। জমির মালিক না হয়েও স্বজনদের নামে বাগিয়ে নেন ৬৪টি প্লট। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। একই ভাবে উপজেলা পরিষদ, বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদ এবং দলীয় বিভিন্ন পদে ত্যাগীদের রেখে অজনপ্রিয় ও অযোগ্যদের স্থান দেওয়া হয়। এসব অধিকাংশ নেতাকর্মী কল-কারখানার ঝুট ও শীতলক্ষ্যা নদীর বালু ব্যবসা, জমি দখল, যানবাহনে চাঁদাবাজি, সরকারী গাছপালা কেটে বিক্রি, কৃষকের জমির মাটি কেটে বিক্রিসহ নানা অপকর্ম করে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে দলীয় পদ বিক্রির অভিযোগও। তাদের অপকর্মের দায় চুমকির উপর পড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে।
চুমকির পরাজয় কারণ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চুমকির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মোয়াজ্জেম হোসেন পলাশ বলেন, তার মতে পারষ্পরিক হিংসা তাদের পরাজয়ের মূল কারণ। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যে সব প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন বা দলীয় মনোনয়ন পাননি, তারাই স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনে ভূমিকা পালন করেছেন। আবার যারা দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলীয় পদে ছিলেন, পরবর্তীতে পদ না পেয়ে অনেকে পক্ষ ত্যাগ করেছেন। এতেই নৌকার ভরাডুবি ঘটে। তবে শিঘ্রই দলীয় ভাবে বসে পরাজয়ের কারন উদঘাটন করা হবে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এবিএম আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, তাদের পরাজয়ের মূল কারণ কালো টাকা। তাছাড়া বিএনপির ভোট স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে যাওয়ায় প্রতিপক্ষের ভোট বেড়ে গেছে। তাছাড়া দলীয় নেতাকর্মীদের ছোটখাট ভুল, বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোতে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের জয়পরাজয়ে কারনেও অনেকে অভিমানে নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছেন।
পক্ষান্তরে স্বতন্ত্র প্রার্থী আকতারউজ্জামনের বিজয়ের পিছনে মূখ্য ভূমিকা ছিল তার ক্লীন ইমেজ, তৃণমূলের সাথে সুসম্পর্ক, অনিয়ম-দূর্নীতি থেকে দূরে থাকা এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালে উন্নয়ন কাজ। ১৯৯৬ সালে তিনি এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ছিলেন। আকতারউজ্জামান ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠরিক সম্পাদক। উপজেলা আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী তার হাত দিয়েই গড়া। ত্যাগী নেতাদের একটি বড় অংশ ছিলেন অবহেলিত। তিনি প্রার্থী হলে অবহেলিতরা সংগঠিত হয়ে মাঠে নামেন। তাছাড়া চুমকির ঘনিষ্ঠদের নানা কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের বহু নেতাকর্মী নির্বাচনে চুমকির পক্ষ ত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর হয়ে নির্বাচন কাজ করায় বিজয় সহজ হয়ছে আকতারউজ্জামানের।