ওসিকে রক্ষা করে তদন্ত প্রতিবেদন
ওসি হয়ে প্রতারনামূলক বিয়ে গুরুতর অপরাধ
নৈতিকস্খলনজনিত গুরুদন্ডের অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি বাধ্যতামূলক
অবসর অথবা নিন্মপদে বা নিন্মগ্রেডে পদাবনতি
শাস্তি না হলে অপরাধ প্রবনতা বৃদ্ধি পাবে
গাজীপুর প্রতিবেদক
‘রেজিষ্ট্রি বিয়ে করে দুইমাস সংসার করার পর গাজীপুরের রিসোর্টে এনে বিয়ে অস্বীকার করেন ওসি মিজান। ফিরে যেতে জোরজবরদস্তি করেন। উপায় না পেয়ে ৯৯৯ নাম্বরে পুলিশের সাহায্য চাই। ডিবি পুলিশ উদ্ধার করে আমাকে গাজীপুরের পুলিশ সুপারের কাছে নিয়ে যায়। আমি তাঁর কাছে সব জানিয়ে লিখিত অভিযোগ করি। তিনি ন্যায় বিচারের আশ^াস দেন। কিন্তু বিচার না করে উল্টো বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে ওসিকে। এসপির কাছে ওসির বিচার চেয়ে দ্বিতীয়বার প্রতারিত হয়েছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইব। তিনি একজন মা। তিনি নিশ্চয় ন্যায় বিচার করবেন’ সোমবার সাংবাদিকদের কাছে এমন অভিযোগ করেন জয়দেবপুর থানার প্রত্যাহার হওয়া ওসি সৈয়দ মিজানুর ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী কলেজ ছাত্রী ঝর্ণা আক্তার।
ঝর্ণা বলেন, রিসোর্টে আমাকে গুন্ডা দিয়ে হত্যার হুমকি দেয় ওসি মিজান। সবকিছু জানিয়ে আমি এসপি সাহেবর কাছে লিখিত ভাবে বিচার চাই। প্রথম স্ত্রীর কথা গোপন করে ওসি মিজান তাকে বিয়ে করে ছিল। তিনি নেশা করেন। বহু নারীতে আসক্ত। যেখানেই চাকুরি করেছেন, সেখানেই নারী কেলেংকারীর জন্ম দিয়েছেন। এ সব কারণে তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা অনেকটা জোর করেই তাকে বিয়েতে বাধ্য করেন। মিজান নিজেও ক্ষমা চেয়ে আর ভুল হবে না জানায়। এসপিসহ সবাই আশ্বাস দেন স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ওসি তার সাথে সংসার করবেন। ডিবি’র ওসি দেলোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের পর তাকে কাজী অফিসে ফেলে রেখে প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান ওসি মিজান। পরদিন থেকে ডিভোর্সের জন্য নানা চাপ, হুমকি দিতে থাকেন। টাকা দিয়ে তদন্ত কমিটিকে কিনে ফেলেছেন এমন দম্ভ করেন। একাধিকবার মানিকগঞ্জ এসে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ডিভোর্সের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশ হেডকোর্য়াটার থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির প্রথান ছিলেন গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সানোয়ার হোসেন। তার কাছে বিয়ের পরবর্তী সব ঘটনা লিখিত ভাবে জানিয়েছি। তারপরও ওসিকে বাঁচিয়ে গোপনে গত এপ্রিল মাসে এসপির মাধ্যমে পুলিশ হেডকোয়াটারে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায় তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় “ওসি তার সাথে সংসার করছেন, মাসে মাসে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠাচ্ছেন’।
ওসির দ্বিতীয় স্ত্রী বলেন, ‘দ্বিতীয় বার বিয়ে করার পর একদিনের জন্যও সংসার করেননি ওসি মিজান। ৬ মাসের মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে ৮ হাজার টাকা পাঠিয়ে ছিল। প্রতিবেদন পাঠানোর আগে তদন্ত কমিটির আমার কাছে অন্তত ফোন করে হলেও ‘টাকা পাঠানোর বিষয়ে সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন ছিল। আমি টাকা নিয়েছি, প্রমাণ দিক তদন্ত কমিটি’।
তিনি বলেন, ‘আসলে তারা মিজানকে শুরু থেকেই বাঁচানোর চেষ্টায় ছিল। ওই চেষ্টার অংশ হিসেবে তারা মিজানের সাথে আমার আবার তড়িঘড়ি বিয়ে দেয়। বিয়ে না দিলে মিজানোর বিরুদ্ধে ওই রাতে ধর্ষণ মামলা হতো। জেলে যেতে হতেন তিনি। সাসপেন্ড হতে তো মিজানকে। আমি একজন কলেজ ছাত্রী। আমার জীবন নষ্ট করে তারা নিজেদের লোককে রক্ষা করেছে। একবারের জন্যও তারা ভাবেননি আমার ভবিষ্যত কি হবে। আমি গাজীপুরের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে ন্যায় বিচার পাইনি। বিচারের জন্য যেখানে যেতে হয় যাব’।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সানোয়ার হোসেন জানান, তদন্ত প্রতিবেদন হেডকোর্য়াটারে পাঠানো হয়ে। তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না।
কমিটির অন্য একজন সদস্য বলেন, দ্বিতীয় স্ত্রীকে টাকা পাঠানোর মানি অর্ডারের রশিদ প্রমাণ স্বরুপ দিয়েছেন ওসি মিজান। এ কারণে অভিযোগকারীর সাথে কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি। নৈতিকস্খলণজনিত অপারাধের জন্য ওসির শাস্তির সুপারিশসহ কিছু বিষয় উল্লেখ না করায় প্রতিবেদন ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ হেডকোর্য়াটার। ক্রুটিবিচ্যুতি ঠিক করে অচিরেই তদন্ত প্রতিবেদন আবার পাঠানো হবে।
জানা গেছে, ওসি সৈয়দ মিজানুর ইসলামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার দক্ষিণ স্বরমঙ্গল গ্রামে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানার ওসি থাকাকালে গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রথম স্ত্রী ও দুই সন্তানের কথা গোপন রেখে রেজিষ্ট্রি করে ওই কলেজ ছাত্রীকে বিয়ে করেন ওসি মিজান। জাতীয় নির্বাচনের আগে তাকে গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় বদলী করা হয়। সেখানে স্ত্রীকে একটি নিয়ে একটি রিসোর্টে থাকতেন ওসি। গত ১৬ জানুয়ারী কলেজ বিয়ে অস্বীকার এবং বিয়ের কাজী ও রেজিষ্ট্রি জাল-জালিয়াতি ছিল জানায়ে দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাড়ি মানিকগঞ্জ ফিরে যেতে চাপ ও ভয়ভীতি দেখান। ৯৯৯ নাম্বর থেকে ফোন পেয়ে জেলা পুলিশ রিসোর্ট থেকে কলেজছাত্রীকে উদ্ধার করে। পরে ওসিকে ডেকে এনে আটক রাখা হয়।
একজন সরকারী কর্মকর্তা জানান, সরকারী কর্মচারী আচরন বিধিমালা অনুযায়ী একজন সরকারী কর্মকর্তার নৈতিকস্খলনজনিত ঘটনা গুরুদন্ড অপরাধের শামিল। এই ধরনের অপরাধের শান্তি বাধ্যতামুলক অবসর, চাকুরি হতে অব্যাহতি, চাকুরি হতে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার এবং সর্বনিন্ম দন্ড নিন্মপদে বা নিন্মগ্রেডে পদাবনতি এর যে কোন একটি। ওসি মিজান একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। তিনি আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য এবং আইনের রক্ষক হয়ে জঘন্য অপরাধ করেছেন। এ ধরণের অপরাধের শাস্তি না হলে অপরাধ প্রবনতা বৃদ্ধি পাবে।