কালিয়াকৈর বিএনপি
# নেপথ্যে দলীয় মনোনয়ন
# কোটি কোটি টাকার ঝুট ব্যবসা
# পদ-পদবি
হুদয় হাসান, কালিয়াকৈর থেকে ফিরে
স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর দলীয় পদ-পদবীর উপর ভর করে জড়িয়ে পড়েন ঝুটবাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে। কয়েকজন নেতার এমন বেপরোয়া কান্ডে বিতর্কেরমুখে পড়ে কালিয়াকৈর উপজেলা বিএনপি। ভাবমুর্তি ফেরাতে কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে ভেঙ্গে দেওয়া হয় উপজেলার সকল ইউনিট কমিটি। গত জুনে ‘ক্লিন ইমিজের’ নেতাদের দিয়ে উপজেলা ও পৌর বিএনপির আহবায়ক কমিটি ঘোষনা করে জেলা বিএনপি। এটি মেনে নিতে পারেননি বাদ পড়াসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। অতীতে নিজেদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও এখন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ব্যারিষ্টার চৌধুরী ইশরাক আহমদ সিদ্দিকীকে কোনঠাসা করতে ঐক্য গড়েছেন তারা। এমনকি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারে তারা গঠন করেছেন কোটি টাকার তহলবিল। তৃণমূল নেতাকর্মী ও বিএনপি সমর্থকদের কথায় উঠে এসেছে এমন চিত্র।
উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য মেহেরুল ইসলাম বকশী বলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির শ্রম বিষয়ক সহ-সম্পাদক হুমায়ুন কবীর খান, কেন্দ্রীয় কমিটির ঢাকা বিভাগ সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুুল, নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক পৌর মেয়র মজিবুর রহমান, উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ভিপি হেলাল উদ্দিন ও সদ্য বহিষ্কৃত সাধারন সম্পাদক পারভেজ হোসেনের দলে অবদান রয়েছে। বিগত দিনে তারা জেল-জুলম সহ্য করে দলের জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু ঘোষিত নতুন কমিটিকে কেন্দ্র করে ওই ৫ নেতা অবস্থান নিয়েছেন জেলা বিএনপি, বিশেষ করে জেলার বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য সচিব ব্যারিষ্টার চৌধুরী ইশরাাক আহমেদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে। তাঁরা একসাথে বিক্ষোভ, প্রতিপক্ষের উপর হামলাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী দিচ্ছেন। এমনকি ঝুট বিক্রির আয় থেকে মোটা অংকের তহবিল তৈরী করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অখ্যাত গণমাধমে অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এতে তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা চরম ভাবে হতাশ।
দলের ত্যাগী ওই নেতা বলেন, ‘ঘোষিত কমিটি উপলক্ষ্য মাত্র। তাদের বিরোধীতার মূলে রয়েছে ‘দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া’, ‘শত কোটি টাকার ঝুট ব্যবসা হাতছাড়া শংকা’ এবং ‘পদ-পদবি হারানো’ এই তিন কারণ। হাইকমান্ড না উদ্যোগ নিলে আগামী নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
‘দলে ঐক্য’ চান জানিয়ে জিয়া ভক্ত মাখদুম আলী বলেন, ব্যারিষ্টার ইশরাক সিদ্দিকীর বাবা চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি জিয়াউর রহমান সরকারের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। অতীতে কালিয়াকৈর থেকে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন তানভীর সিদ্দিকীই পেয়ে আসছিলেন। কাজী ছায়েদুল আলম, হুমায়ুন কবীর খান, মজিবুর রহমান, হেলাল উদ্দিন ও পারভেজ আহমেদকে বিএনপিতে পদ-পদবি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। এখন তারাই তাঁর ছেলে ইশরাকের চরম বিরোধীতা করছেন। বয়সের ভারে গত ৮-১০ বছর ধরে রাজনীতির ময়দানে অনুপস্থিত তানভীর সিদ্দিকী। এ সুযোগে কাজী ছায়েদুল আলম বাবুল, হুমায়ুন কবীর খান ও মজিবুর রহমান নিজেদের গাজীপুর-১ (কালিয়াকৈর) আসনের এমপি প্রার্থী হিসেবে প্রচারনা চালিয়ে আসছিলেন। এ নিয়ে তাদের তিনজনই জড়িয়ে পড়েন মনোনয়ন যুদ্ধে। কিন্তু কেন্দ্রীয় বিএনপি অনেকটা চমকে দিয়ে তানভীর সিদ্দিকীর ছেলে ব্যারিষ্টার ইশরাক সিদ্দিকীকে জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটিতে ‘সদস্য সচিব’ করে। ইশরাক রাজনীতিতে আসায় উজ্জীবিত হয়ে উঠে কালিয়াকৈর বিএনপি। কিন্তু ইশরাকের রাজনীতিতে আগমন ওই তিন নেতার এমপি হওয়ার স্বপ্ন ‘বিনা মেঘে বর্জ্রপাতের’ ধূলিসাৎ হওয়ার উপক্রম হয়। ওই সময় থেকে তারা ইশরাকের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার টালাতে শুরু করেন।
উপজেলার বিএনপির সভাপতি হেলাল উদ্দিন ও সাধারন সম্পাদক পারভেজ আহমেদের নানা অপকর্মের বিবরণ তুলে ধরে একাধিক উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মী জানান, হেলাল উদ্দিন কালিয়াকৈর কলেজের ভিপি, উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি, উপজেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন সামনের কাতারে। জেল-জুলম সহ্য করেছেন। কিন্ত শেখ হাসিনার পতনের পর রূপ বদলে যায় তাঁর এবং উপজেলা বিএনপি সাধারন সম্পাদক পারভেজ আহমেদের। কালিয়াকৈরের বিভিন্ন কল-কারখানার ঝুট থেকে মাসে আনুমানিক কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়। পূর্বে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ২০২৪ সালে হাসিনার পতনের পর ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন ওই ৫ নেতা ও কালিয়াকৈর পৌর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সাইজুদ্দিনের সিন্ডিকেট। গত ১৪ মে কালিয়াকৈর উপজেলা, পৌরসভাসহ জেলার আটটি ইউনিটের কমিটি বাতিল করে জেলা বিএনপি। এরপর তৃণমূল নেতা–কর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। সিদ্ধান্ত ক্লিন ইমেজের নেতাদের কমিটিতে দায়িত্ব দেওয়ার। এতে বাদ পড়েন বিলুপ্ত উপজেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি হেলাল উদ্দিন ও সাধারন সম্পাদক পারভেজ আহমেদ গত ১৪ জুন মৌচাক ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম সিকদারকে আহবায়ক ও এম আনোয়ার হোসেনকে সদস্য সচিব করে উপজেলা বিএনপি এবং মামুদ সরকারকে আহবায়ক ও মহসিন উজ্জামানকে সদস্যসচিব করে কালিয়াকৈর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষনা করে জেলা বিএনপি। পরদিন থেকেই পদবঞ্চিত এবং আগামী নির্বাচনে এমপি মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মিলে ঘোষিত কমিটির বিরোধী শুরু করেন। দিতে থাকেন নানা কর্মসূচী। প্রতিপক্ষের উপর হামলা এবং ইশরাক সিদ্দিকীকে নিয়ে প্রকাশ্যে বাজে মন্তব্য করায় পারভেজ আহমেদকে দল থেকে বহিস্কার করে কেন্দ্রীয় কমিটি। হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হলে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
শ্রীফলতলী এলাকার বিএনপির কর্মী চাঁন মিয়া, শহীনূর আলম, সূত্রাপুর এলাকার হিরন, বিল্লাল হোসেনসহ উপজেলা বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মীর দাবি কালিয়াকৈর বিএনপিতে মতভেদের মূলে রয়েছেন সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান। তার সাথে যুক্ত হয়েছেন কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল। তারা কর্মীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছেন। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দুইজনই কালিয়াকৈর জুড়ে অসংখ্য ব্যানার-ফেষ্টুন লাগিয়েছেন। তারা ইশরাককে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তাঁকে হেনস্থা করতেই পদবঞ্চিতদের নিয়ে দলের বিরুদ্ধে আলাদা সভা-সমাবেশ করছেন। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন কালিয়াকৈরের সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান। তিনি গত ১৫ বছর স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সবচেয়ে ঘনিষ্ট ছিলেন। এলাকায় তিনি ‘মোজাম্মেলের ছেলে’ নামে পরিচিত। তাঁর ছত্রছায়ায় থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বিগত আন্দোলন সংগ্রামে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে মামলা হলেও শেখ হাসিনার পুরো শাসনামলে তাঁর বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি।
কালিয়াকৈর বিএনপির উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনে অনিয়ম হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সম্পাদক কাজী ছায়েদুল আলম বাবুল বলেন, এসব বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন একাধিক বিএনপি নেতা। অভিযোগ প্রমাণীত হলে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
কোন অনিয়ম হয়নি জানিয়ে ব্যারিষ্টার চৌধুরী ইশরাাক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, জেলা কমিটি এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে ক্লিন ইমেজের নেতাদের নিয়ে আহবায়ক কমিটি করা হয়েছে। কেউ কেউ আহবায়ক কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন। বাদ পড়াদের মধ্যে যারা ত্যাগী, দলে ইমেজে রয়েছে তাদের পূর্নাঙ্গ কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হবে। না বুঝেই বিভ্রান্ত হয়ে কেউ কেউ অপপ্রচার চালাচ্ছেন।


