নূরজাহান নীরা
জীবনের প্রয়োজনে ছুটতে হয়।এ ছুটোছুটি চলে এ পথ থেকে ও পথ।কয়েকমাস যাবৎ বেনাপোল যাওয়া আসা করছি।নারায়ণগঞ্জ থেকে বেনাপোন অনেকটা পথ।জানুয়ারি মাসে শ্বাশুড়িকে যশোর থেকে নিয়ে এসেছিলাম।ফেব্রুয়ারীর এক তারিখে সাথে করে নিয়ে এসেছি।ঝিনাইদহ আরাবপুর থেকে ওনাকে পাগলা কানাইয়ের রিকসায় তুলে দিয়ে চলে যাই বেনাপোল।যাওয়ার পথে শ্বাশুড়ি বললেন,তুমি সারা পথ ঘুমিয়েছ।বললাম,মা পাশে থাকলে নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়।অন্য সময় পারি না।পাশের ছিটে অপরিচিত কেউ থাকে।জানালার পাশে ছিট পেলে বাইরের দিকে মুখ রাখি আর ভিতরে ছিট হলে অন্য দিকে মুখ রাখি যাতে কোন ঘ্রাণ নাকে না পৌঁছে। অজ্ঞান পার্টি মলম পার্টির অভাব নেই।
বেনাপোল যাওয়ার চারদিন পরই শ্বাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েন।তখনই আসতে বলেন কিন্তু এতদূর চেম্বার,মাত্র সাতদিন থাকি।বুঝিয়ে না যাওয়ার কথাই বললাম। যোগাযোগ রাখি,শ্বাশুড়ির কথা আসতেই হবে।সব সময় যশোর হয়ে ঝিনাইদহ যাওয়া হয়,এবার চৌগাছা দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।ডিহি ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সাথে একটু দেখা করার দরকার ছিল।এ পথে দু কাজ সারতেই বের হই এ পথে।ভাগিনা বাইকে করি সাড়াতলা বাজারে নামিয়ে দেয়।কমান্ডার চাচার সাথে দেখা করে চৌগাছার গাড়িতে উঠি।ইচ্ছে ছিল চৌগাছা থেকে কালিগঞ্জ,এরপর গান্না।চৌগাছা নেমে দেখি কোটচাঁদপুর কোটচাঁদপুর ডাকছে।মনে পড়ল,মামা শ্বশুরের বাড়িতে বেড়াতে গিয়লছিলাম জালালপুর তখন শ্বাশুড়ি মা বলেছিলেন, একটু সামনেই কোটচাঁদপুর। উঠে গেলাম।কোটচাঁদপুর নেমেই গান্নার গাড়ি। জীবনের প্রথম এ পথে আসা।একা। কোটচাঁদপুর থেকে কিছুক্ষণ আসতেই বড় মাঠ। মাঠের পথে কয়েকজনের ভিড়।গাড়ি থামল।বাইক এক্সিডেন্ট। বাইকটা কাদা মাখা,হেলমেট দু টুকরো।ছেলেটা শক্ত হয়ে আছে।জীবিত না মৃত বুঝা গেলনা, তার আগে আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করল।গান্না পৌঁছে প্রথমে ফুফু শ্বাশুড়ির সাথে দেখা করি এরপর যাই শ্বাশুড়ি মার কাছে।সেখানে খাওয়া দাওয়া করে বের হই ১.৪০ মিনিটে। আরাবপুর থেকে ২.৪০ গাড়ি ছাড়ে।সাধারণত ২ ঘন্টা থেকে ২.৩০ ঘন্টা লাগে ভাঙা পৌঁছাতে। তবুও টিকিট নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলাম,ভাই কতক্ষণ লাগবে? বলল,সর্বোচ্চ ৩.৩০ ঘন্টা। কিন্তু পথে ড্রাইভারের সময় ক্ষেপণ দেখে বিরক্ত লাগছিল। সম্ভবত মাগুরা পার হয়ে পথে আবারও এক্সিডেন্ট। পিকাপ চালক। সামনের অংশে চামড়া নেই একটুও।হাঁটুর নিচের অংশ আছে কি না বোঝা গেলো না।মুখটা ভালো আছে,মাথা হালকা রক্তে ভেজা।ধরাধরি করে ভ্যানে তোলার চেষ্টা। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ছিলাম,তারপর মনে হচ্ছিল চলন্ত বাস গোলে ঘুরছে।নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসবে।চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুম হলো না সময়ের ভাবনায়।ছয়টার মধ্যে ভাঙা পৌছাতে পারলে সহজ হত। আটটার পর লঞ্চ বন্ধ হয়ে যায়। ভাঙা পৌছানোর আঠার কিঃমিঃ পথ বাকি,সময় গেছে তিন ঘন্টা দশ মিনিট।ড্রাইভারের সাথে কথা কাটাকাটি হলো।মেজাজটা আগুন বরাবর।পড়লাম জ্যামে।গা বমি ভাবটা তখনও কমেনি।ভুলতে পারছি না।কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবে হয়ত লোকটা অথচ তখনও কিছু বলার চেষ্টা করছিলো।হয়ত বলছিল,আমাকে বাঁচাও।আহা পথ! কেউ পিছন থেকে ধাক্কা দিয়েছিল পিকাপটাকে।প্রচন্ড ঘেমে গেছি।মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম।অনেক যন্ত্রণার পর পৌছালাম ভাঙা ৭.৫। সাথে সাথে গাড়ি পেলাম।লোক কম, বললাম ভাই,আমরা কিছু বেশি দিব চলেন।যাত্রীর অপেক্ষায় থাকলে আমরা হয়ত লঞ্চ পাব না।লোকটা যতনে দ্রুত গাড়ি চালাতে লাগল।সময় দেখার জন্য মোবাইল বের করলাম।মিস কল বিশটা মত। এক নাম্বারে বেশি। কল করলাম। কথা হলো,কথায় কথায় অভিযোগ করলেন।আমিও জানিয়ে দিলাম,আমার কোন দায়বদ্ধতা নেই,কেন করব এ কাজ? অভিযোগ করার অধিকার নেই তার। ফোন রেখে অনুতপ্ত হলাম।এভাবে না বললেও পারতাম।পথে মন দিলাম।গাড়ি পিছনে না সামনে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না।স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছি।কর্তার ফোন।বললাম,পাচ্চর পার হচ্ছি।লঞ্চ না পেলে আজ আর আসা হবে না।ফেরত যাব মালিগ্রাম। চালক খুবই মনোযোগ সহকারে আমাদের পৌঁছে দিলেন।ভাড়া বেশি নিলেন না। শেষ লঞ্চে উঠলাম।চোখে কিছুই দেখছি না।লঞ্চ ছাড়লে পিছনে গেলাম মুখটা ভেজাতেই হবে।সিঁড়িতে পা রাখতেই নজর পড়ল চুলার দিকে। ভাতের পানি উতরে পড়ছে আগুনে,আগুন পানি পেয়ে দিগুন উচ্চতায়।পাশে গ্যাস সিলিন্ডার। ভয় পেলাম যেনো। হাতমুখ ধুয়ে নেমে এলাম।খুঁজে পেলাম ভাতওয়ালাকে। বললাম,ভাত যে বসিয়েছেন খেয়াল আছে? উনি দৌড় দিলেন।আমি এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে।যাওয়ার দিন সকালে দেখছি প্রচুর ভিড় এখানে।মনে হলে সকালে না খেয়ে বেরিয়েছে।অথবা ইলিশ ভাজা খেতে এই হুমড়ি খেয়ে পড়া।বাঙালি ভাগ্য।জাতীয় মাছ ইলিশ সবার বরাতে জোটে না আর জাতীয় সম্পদ গ্যাস কিনতে হিমশিম খাচ্ছি। এই লঞ্চে একমাত্র ব্যবস্থা জাতীয় সম্পদ জ্বালালি গ্যাস দিয়ে জাতীয় মাছ ইলিশ ভাজা। জাতীয় জাতীয় কম্বিনেশন বাঙালি মুখে স্বাদ আহা! এই স্বাদ পেতেই উপছে পড়া ভিড়।যাক,এখন কিছুটা ভালো লাগছে।কুয়াশা জড়ানো শীতল বাতাস।ভালোই।এত রাতে কখনও লঞ্চ পার হইনি।শেষ লঞ্চ। ভিতরে বসার জায়গা নেই।সামনে সিঁড়িতে বসলাম।দূরের আলো চোখে পড়ল।ঝলমল করছে ছোট ছোট আলোগুলো। একটা গল্প লিখেছি।নদীকে কেন্দ্র করে,” নোঙর”। মিলাতে চেষ্টা করলাম রাতের যে বিবরণ গল্পে এসেছে তাতে কোন অসংগতি আছে কি না।না,ঠিক আছে,বরং কিছু উপমা সংযোজন করা যেতে পারে।গল্প নিয়ে ভাবতে ভাবতে পৌছে গেলাম ঘাটে।তারপর বাসায়..
Leave a Reply