ডেস্ক প্রতিবেদন
ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্য ও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গতকাল শুক্রবার খাস (বিশেষ) বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। ফজরের পর ঈমানের উপর বয়ানের মাধ্যমে মূল আনুষ্ঠানিকতার সূচনা করেন ইজতেমার শীর্ষ মুরুব্বি পাকিস্তানের রাইবেন্ডের মাওলানা আহমদ বাটলা। তার উর্দু ভাষার বয়ান বাংলায় তরজমা করে শোনান বাংলাদেশের মাওলানা মো. নুরুর রহমান। পরে তিনি আমল, আখলাক, দাওয়াত ও তাবলীগ সম্পর্কে দীর্ঘ বয়ান করেন।
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে সকাল ১০টায় শুরু হয় আলাদা আলাদা মিম্বারে ‘বিশেষ প্রোগ্রাম’ বয়ান। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে মিম্বারে বয়ান করেন ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. সানাউল্লাহ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মিম্বারে বয়ান করেনপাকিস্তানের রাইবেন্ডের ডা. মো. নওশাদ এবং খাওয়াছ বা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের জন্য মাঠের উত্তর-পূর্ব দিনের টিনশেড মসজিদে বয়ান করেন ভারতের দিল্লির মাওলানা মো. আকবর শরীফ। জু’মার পর বয়ান করেন তাবলীগের জর্ডানের জিম্মদার শেখ ওমর। তাঁর বয়ান বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা জাকির হোসেন।
এদিকে তিন দিনের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দিনে গতকাল লাখ লাখ মুসল্লির অংশ গ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছে বৃহত্তম জু’মার নামায। নামাযে ইমামতি করেন তাবলীগ জামাতের প্রথম পর্বের অন্যতম শীর্ষ মুরুব্বী ঢাকার কাকরাইল মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা জুবায়ের। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ জু’মার নামাযে শরিক হন। আগামী কাল রবিবার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে প্রথম পর্বের সমাপ্তি হবে। আগামী ৯ ফেব্রæয়ারি দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শুরু হয়ে শেষ হবে ১১ ফেব্রæয়ারি।
চলতি বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের অংশ গ্রহণ গত বছরের তুলনায় অনেক বেশী জানিয়ে প্রথম পর্বের ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মো. হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, প্রায় ৫০০ বিঘার মূল প্যান্ডেল মুসল্লিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। প্যান্ডেলের ভিতর স্থান না পেয়ে লাখ লাখ মুসল্লি খোলা মাঠ, আশপাশের সড়ক, ফুটপাতে অবস্থান নিয়েছেন। এখনো দেশ-বিদেশ থেকে মুসল্লি আসা অব্যাহত রয়েছে। লাখ লাখ মুসল্লির পদচারণায় শিল্প শহর টঙ্গী এখন ধর্মীয় উৎসবের নগরীতে পরিনত হয়েছে। শীর্ষ মুরব্বিদের বয়ান এবং ইবাদত করে কাটছে তাদের সময়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ বিশ্রে ৪৩টি দেশ থেকে প্রায় ২ হাজার মুসল্লি ইজতেমায় এস পৌছেন ছেন বলে জানিয়েছেন গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম। অন্যদিকে ইজতেমা মাঠে শুক্রবার আরো দুই মুসল্লীর মৃত্যু হয়েছে।
জু’মা নামাযে মুসল্লির ঢল :
জু’মার নামাযে অংশ নিতে গতকাল শুক্রবার ইজতেমা ময়দানে চারদিক থেকে আসা মুসল্লিদের ঢল নামে। সকাল ৮টার পর থেকেই গাজীপুর, নরসিংদী, রাজধানী ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকা এবং দূলদুরান্ত থেকে স্রোেেতর মত মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানের দিকে আসতে থাকেন। ভীড়ের চাপে সকাল ১১টার পর টঙ্গীর টঙ্গী- বিমানবন্দর সড়ক, টঙ্গী-পূবাইল সড়ক এবং আবদুল্লাপুর-আশুলিয়া সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মুসল্লিরা মাঠের ভিতরে স্থান না পেয়ে মাঠের পাশের সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ফুটপাত, অলিগলিতে অবস্থান নেন। অনেকে, ভবনের ছাদ, বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের ছাদে দাঁড়িয়ে জু’মার নামাযে অংশ নেন। বেলা দেড়টায় অনুষ্ঠিত নামাযে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাজীপুরের সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম, পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম, জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম নামাযে অংশ নেন। উপমাহাদেশের বৃহৎ এ জামায়াতে ইমামতি করেন তাবলীগের শূরা সদস্য বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা জোবায়ের। নামায শেষে মোনাজাতে দেশ ও মুসলিম উম্মার শান্তি কামনা করা হয়।
নানা অব্যবস্থাপনা:
পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার ইজতেমা ময়দানে যাতায়দের সড়ক-মহাসড়কগুলো যানজট ও হকার মুক্ত রাখার ঘোষণা দেওয়া হলেও দেখা গেছে উল্টো চিত্র। শুক্রবার সকাল থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরা থেকে আবদুল্লাহপুর, আবদুল্লাহপুর থেকে কামারপাড়া, টঙ্গীর নিমতলী থেকে স্টেশন রোড পর্যন্ত তীব্র ছিল যানজট। মুসল্লিদের যত্রতত্র পারাপার, যানবাহনের ইচ্ছা মাফিক পার্কিং, জন¯্রােত ইত্যাদি কারণে দিনভর যানজট লেগে চরম দুভোর্গ পোহাতে হয়েছে মুসল্লী ও সাধারন যাত্রীদের। পুলিশ থাকলেও গল্পগুজবে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে তাদের। সড়ক-মহাসড়কের ফুটপাতগুলোতে ছিল হকারদের দৌরাত্ব। প্যান্ডেলের ভিতর জায়গা না পেয়ে অন্যত্রা আশ্রয় নেওয়া মুসল্লিদের ওযু-গোসল, টয়লেট, রান্না ও খাবারের সংকট ছিল তীব্র। হোটেল গুলোতে খাবার থাকলে খারাপ মান ছিল, দাম ছিল কয়েকগুণ বেশী। এসব বিষয়ে প্রশাসনের কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি বলে জানান রংপুর থেকে আসা মুসল্লি মো. বিল্লাল হোসেন (৭০)।
বাস চাপায় পুলিশ সদস্য নিহত:
বিশ্ব ইজতেমায় দায়িত্ব পালন করতে আসার পথে বাসের ধাক্কায় পুলিশের এক এএসআই নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন এক এসআই। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের থানার মিলগেট এলাকায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত মো. হাসানুজ্জামান মানিকগঞ্জ জেলা আদালতে কর্মরত ছিলেন। আহত পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমির হামজা মানিকগঞ্জ জেলার পুলিশ কন্টোল রুমে কর্মরত রয়েছেন।
পুলিশ জানায়, মোটরসাইকেলে করে নিহত হাসান ও আহত আমির হামজা মানিকগঞ্জ থেকে ইজতেমায় ডিউটিতে আসছিলেন। ইজতেমা মাঠের কাছে মিলগেট এলাকায় পৌছারৈ পিছন থেকে বলাকা পরিবহনের একটি বাস তাদের বহনকারী মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে তারা গুরুতর আহত হন। টঙ্গী থানা পুলিশ প্রথমে তাদের উদ্ধার করে টঙ্গী হাসপাতালে পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এএসআই হাসান মারা যান।
আরো তিন মুসল্লির মৃত্যু:
বিশ্ব ইজতেমায় আরও তিন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার ভোর মতিউর রহমান (৬০) ও এখলাস উদ্দিন (৭০) এবং জু’মার নামাযের আগে শাহ আলম (৬০) নামে আরেক একজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ৬ মুসল্লীর মৃত্যু হলো।
মতিউর রহমান জামালপুর জেলার সদর থানার পাকুল্লা গ্রামের বাসিন্দা। শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। এখলাস উদ্দিন মারা যান বার্ধক্যজনিত কারণে। তার বাড়ি নেত্রকোনা জেলার সদর থানার স্বল্ফদুগিয়া গ্রামে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ভোলার ভোল্লা গ্রামের শাহ আলম। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের লাশের জিম্মাদার প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন।